ইমাম ও ইমামতি (পর্ব-৬)
আব্দুর রাকীব (মাদানী), দাঈ দাওয়া’হ সেন্টার খাফজী, সউদ আরব
মাসবুকের বিধান:
১-মাসবূক কাকে বলে? আলোচ্য বিষয়ে মাসবূক বলতে আমারা সেই নামাযী ব্যক্তিকে বুঝাতে চাচ্ছি, যার ইমাম তার পূর্বে এক বা একাধিক রাকাআত কিংবা নামাযের কিছু অংশ সমাপ্ত করেছে আর সে নামায শুরু হওয়ার পর জামাআতে প্রবেশ করেছে।
২-মাসবূক কিভাবে নামাযে আসবে?
নামায পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে বা অন্য কোনো স্থানে আগমন করার সময় যদি নামাযীর যথাস্থানে পৌঁছানোর পূর্বে জামাআত দাঁড়িয়ে যায় কিংবা জামাআত দাঁড়ানোর পর সে যদি সেই জামাআতে শরীক হতে চায়, তাহলে সে যেন ধীর-স্থীর অবলম্বন করতঃ জামাআতে যায়, দৌড়া-দৌড়ি বা তাড়াহুড়া না করে।
নবী (সাঃ) বলেনঃ
” إذا سمعتم الإقامةَ فامشوا إلى الصلاةِ و عليكم بالسكينةِ والوقارِ، ولا تُسرعوا، فما أدركتم فصلّوا، وما فاتكم فأتِمّوا” متفق عليه
“যখন তোমরা ইকামত শুনবে, তখন তোমরা শান্ত ও স্থৈর্য সহকারে নামাযে চলো, দ্রুত চলো না। যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে তা পূরণ করে নিবে”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৩৬/মুসলিম, মাসাজিদ, নং ১৩৫৯]
মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, “কারণ তোমাদের কেউ যখন নামাযের ইচ্ছা করে, তখন সে নামাযেই থাকে”।
তাই নামাযে যে ভাবে ধীর-স্থীর অবলম্বন করতে হয়, সে অবস্থা যেন নামাযে আসার সময়ও থাকে। তাছাড়া দৌড়ে বা দ্রুত আসলে মানুষ হাঁপায় এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না, যার ফলে তার নামাযের খুশু-খুযুতে ব্যাঘাত ঘটে।
৩-মাসবূক যে কোনো নফল না পড়ে অতি সত্তর জামাআতে শরীক হবেঃ
নামাযী যদি এমন সময় মসজিদে প্রবেশ করে যে, জামাআত দাঁড়িয়ে গেছে, তাহলে সে সুন্নতে মুআক্কাদা বা তাহিয়্যাতুল মসজিদ কিংবা অন্য কোন নামায শুরু করবে না; বরং সরাসরি ফরয জামাআতে শরীক হবে। নবী (সাঃ) বলেনঃ “যখন নামাযের ইকামত দেওয়া হবে, তখন ফরয নামায ব্যতীত অন্য কোন নামায নেই”। [মুসলিম, সালাতুল মুসাফেরীন, নং ১৬৪৪]
৪-মাসবূক ব্যক্তির সামনের কাতারে স্থান না পেলে পিছনে একাই দাঁড়ানো:
মাসবূক মসজিদে প্রবেশ করার পর যদি দেখে যে, সামনের কাতারে খালি স্থান নেই, তাহলে সে কি সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নিয়ে কাতার তৈরি করবে, না ইমামের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, না অন্য কারো আসার অপেক্ষা করবে, যেন তার সাথে মিলে দু জনে কাতার তৈরি করে, না একা একা পিছনে দাঁড়াবে?
এ বিষয়ে উলামায়ে কিরামের মতভেদ বিদ্যমান। এক দল ইসলামী পণ্ডিত মনে করেন, লাইনের পিছনে একা একা এক লাইনে নামায পড়লে নামায হবে না। কারণ নবী (সাঃ) বলেনঃ “লাইনের পিছনে একা নামায আদায়কারীর নামায হয় না”।[আহমদ, ৪/২৩ ইবনু মাজাহ, অধ্যায় ইকামাতুস স্বালাত, নং ১০০৩] অন্য হাদীসে এসেছে, একদা নবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে লাইনের পিছনে একা নামায পড়তে দেখলে তাকে পুনরায় নামায আদায় করার আদেশ দেন”। [আহমদ, তিরিমিযী, আবওয়াবুস্ স্বালাত, নং ২৩০, আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, নং ৬৮২, সহীহ সুনান আবু দাঊদ, আলবানী, নং৬৩৩]
যদি লাইনের পিছনে একা নামায পড়া শুদ্ধ হত, তো নবী (সাঃ) তাকে পুনরায় আদায় করার আদেশ করতেন না। তাছাড়া উপরোক্ত দলীলকে শিথিলকারী কোন অন্য দলীলও পাওয়া যায় না। এসব কারণে উলামাগণের একটি দল লাইনের পিছনে একা নামায আদায়কারীর নামায বাতিল মনে করেন।
ইসলামী পণ্ডিতগণের অপর দলটি ওজর বশতঃ লাইনের পিছনে একা নামায পাঠকারীর নামায শুদ্ধ মনে করেন, বিনা ওজরে নয়। ওজরের ব্যাখ্যা এইরূপ যে, নামাযী মসজিদে প্রবেশ করার পর যখন দেখে যে, সামনের লাইনে তার জন্য কোন স্থান নেই, তখন পিছনে একা নামায পড়া ছাড়া আর তার কোন উপায় থাকে না। তাই এই অবস্থায় তার পিছনে একা নামায পাঠ করাটা একটি ওজর। তারা মনে করেন, লাইনের পিছনে একা ব্যক্তির নামায শুদ্ধ না হওয়াটা নামাযীর লাইনবদ্ধ হওয়া জরূরীর প্রমাণ। কিন্তু সে কাতারবদ্ধ হতে অপারগ কারণ; সামনের কাতারে জায়গা নেই। তাই এমতাবস্থায় তার জন্য এই শারয়ী মূলণীতি প্রযোজ্য যে, [লা-ওয়াজিবা মাআ’ল ইজ্ য] অপারগ হলে ওয়াজিবের বিধান প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ কেউ কোন কিছু করতে অক্ষম হলে, তা করাটা তার উপর জরূরী থাকে না। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (কাজেই তোমরা আল্লাহকে তোমাদের সাধ্যমত ভয় কর।) [আত্ তাগাবুন/১৬] তিনি আরো বলেনঃ (আল্লাহ কোন ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু আরোপ করেন না।) [বাকারাহ/২৮৬] এই মতটি মধ্যম মত হিসাবে শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া, শাইখ সা’দী, শাইখ আলবানী, শাইখ ইবনে উসায়মীন প্রমুখ গ্রহণ করেছেন।
এই বিষয়ের সারাংশ স্বরূপ উল্লেখ্য যে,
ক-মাসবূক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করার পর নিজে একা কাতার তৈরি না করে সামনের লাইনে ঢুকার চেষ্টা করবে। এই সময় মুসল্লীদের তার জন্য স্থান করে দেওয়া উচিৎ। নবী (সাঃ) বলেনঃ “তোমরা কাতার সোজা করে নাও, কাঁধ বরারবর করে নাও, খালি স্থানগুলি পূরণ করে নাও এবং নিজ ভায়ের হাত ধরার ক্ষেত্রে নম্র হও..”। [আহমদ, আবু দাঊদ, নাসাঈ, সহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব]
আবু দাঊদ (রহঃ) নিজ ভাইর হাত ধরার ক্ষেত্রে নম্র হও এর অর্থে বলেনঃ “যখন কেউ লাইনে প্রবেশ করতে আসে, তখন প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ যে, তারা যেন তার জন্য নিজ কাঁধ নম্র করে যেন সে লাইনে প্রবেশ করতে পারে।
খ- এই সময় কাউকে সামনের কাতার থেকে টেনে নিয়ে কাতার তৈরি করা যাবে না। কারণ এমন করার কোন সহীহ দলীল নেই। বরং এতে কিছু শারঈ বিধান লঙ্ঘিত হয় যেমনঃ
১-যাকে টানা হয়, তাকে সমস্যায় ফেলা হয় এবং তার খুশু-খুযুতে ব্যাঘাত ঘটে।
২-পূর্ণ লাইনে খালি স্থান তৈরি করা হয়; অথচ লাইন পূরণ ও মিলনের আদেশ করা হয়েছে।
৩-যাকে টানা হচ্ছে তাকে উত্তম ফযীলতের স্থান থেকে কম মানের স্থানে স্থানান্তর করা হয়।
৪-পুরা লাইনে ব্যাঘাত ঘটে কারণ; এক জনের স্থান খালি হওয়ার কারণে লাইনের সবাইকে তা পূরণের জন্য নড়া-চড়া করতে হয়। [শারহুল মুমতি, ইবনে উসায়মীন,৪/২৭২-২৭৩]
গ-সে ইমামের পাশে গিয়ে তার বরাবর দাঁড়িয়ে নামায পড়বে না কারণঃ
১-এতে মানুষের কাঁধ ডিঙ্গানোর প্রয়োজন রয়েছে; অথচ নামাযীর কাঁধ ডিঙ্গানো নিষেধ।
২-ইমামের সাথে তাঁর বরাবর নামায পড়লে সুন্নতের বরখেলাফ করা হয় কারণ; সুন্নত হচ্ছে ইমামের স্থান মুক্তাদীর স্থান থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র। [প্রাগুক্ত ৪/২৭৩]
ঘ-মাসবূক সামনের লাইনে ফাঁকা স্থান না পেলে এবং তাতে প্রবেশ না করতে পারলে, সে আর অন্য মাসবূকের অপেক্ষা করবে না; বরং একাই পিছনের লাইনে নামায পড়বে কারণঃ
১-অপেক্ষা করতে করতে রাকাআত ছুটে যেতে পারে আর অনেক সময় সেটি শেষ রাকাআত হলে জামাআতই ছুটে যেতে পারে। আর এমন হলে জামাআতের ফযীলত থেকে সে মাহরূম হয়ে যাবে আর নামাযও ছুটে যাবে। [প্রাগুক্ত,৪/২৭৪]
৫-মাসবূক কি ভাবে এবং কি বলে জামাআতে প্রবেশ করবে?
মাসবূক ব্যক্তি প্রথমে দণ্ডয়মান অবস্থায় তকবীরে তাহরীমা দিবে অতঃপর ইমামকে যেই অবস্থায় পাবে, সেও সেই অবস্থায় চলে যাবে কারণ; তকবীরে তাহরীমা নামাযের রুকন তাই তা ব্যতীত নামায হয় না। অনেক সময় এই অবস্থায় মাসবূকের উপর দুটি তাকবীর একত্রিত হয়ে যায়। যেমন ধরুন মাসবূক এমতাবস্থায় জামাআতে প্রবেশ করছে, যখন ইমাম রুকূ বা সাজদার জন্য তাকবীর দিচ্ছেন। এই সময় মাসবূকের প্রতি প্রথমে তাকবীরে তাহরীমা দেওয়া জরূরী অতঃপর রুকূর বা সাজদার তাকবীর দেওয়া। এটি উত্তম নিয়ম তবে যদি কেউ রুকূ বা সাজদার তকবীর, যাকে তাকবীরাতুল ইন্তিকাল বলা হয় তা না দিয়ে শুধু তাকবীরে তাহরীমা দেয়, তাহলে তার জন্য এটিই যথেষ্ট হবে। [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিকহী, ড.সালেহ ফাউযান, পৃঃ ৯৮]
অতঃপর ইমাম যেই অবস্থায় থাকবে সেও সেই অবস্থায় শরীক হবে। ইমাম সাজদায় আছে বলে তাঁর সাজদা থেকে দাঁড়ানোর অপেক্ষা করা বা আরো এইরূপ অন্য কিছুর অপেক্ষা করা ভুল। নবী (সাঃ) বলেনঃ “যখন তোমাদের কেউ নামাযে আসবে এমতাবস্থায় যে ইমাম কোন এক অবস্থায় আছেন, তাহলে সে যেন তেমন করে যেমন ইমাম করেন”। [তিরমিযী, অনুচ্ছেদ নং ৬২ হাদীস নং ৫৯১, শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন] তিনি (সাঃ) আরো বলেনঃ “যখন তোমরা ইমামকে সাজদারত অবস্থায় পাবে, তখন তোমরাও সাজদা করবে কিংবা রুকূ অবস্থায় পাবে, তখন তোমরাও রুকূ করবে কিংবা কিয়াম অবস্থায় পাবে, তখন তোমরাও দাঁড়াবে”। [সিলসিলা সহীহা নং ১১৮৮]
৬-মাসবূক দুআই ইস্তিফ্তাহ (সানা) পড়বে কি?
দুআয়ে ইস্তিফ্তাহ বা সানা পড়ার সময় হচ্ছে, তাকবীরে তাহরীমার পর এবং সূরা ফাতিহা পড়ার পূর্বে। তাই মাসবূক যদি ইমামের রুকূ, সিজদা বা তাশাহ্ হুদের সময় জামাআতে শরীক হয়, তাহলে তাকে সানা পড়তে হবে না। কারণ এগুলো সানা পড়ার স্থান নয় এবং এসব স্থানের দুআ ও যিকির নির্দিষ্ট। কিন্তু মাসবূক যদি কিয়াম অবস্থায় ইমামকে পায় আর তার অধিক ধারণা হয় যে, সে ইমামের রুকূ করার পূর্বে সানা পড়ে সূরা ফাতিহা পড়তে পারবে, তাহলে সে সানা পড়বে; নচেৎ শুধু সূরা ফাতিহা পড়বে। কারণ সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব আর সানা পড়া মুস্তাহাব। এটাই প্রাধান্যযোগ্য মত। ইমাম নবভী (রহঃ) বলেনঃ “মাসবূক ইমামকে যদি কিয়াম ছাড়া অন্য অবস্থায় পায়, তাহলে দুআ’য়ে ইস্তিফতাহ (সানা) পড়বে না,… আর যদি কিয়াম অবস্থায় পায় এবং অনুমান করতে পারে যে, সে সানা, তাআ’উয (আউযুবিল্লাহ) ও ফাতিহা পড়তে পারবে, তাহলে সানা পড়বে…আর যদি বুঝতে পারে যে, এসব পড়া সম্ভব নয় কিংবা সন্দেহ হয়, তাহলে সানা পড়বে না”। [মাজমূ ৩/৩১৮-৩১৯]
এ সম্পর্কে কিছু উলামা মনে করেন, সির্রী (নিরব) নামাযে মাসবূক সানা পড়বে কিন্তু জাহরী (সশব্দিক) নামাযে যদি ইমামকে সূরা ফাতিহা পড়ার পূর্বে নিরব অবস্থায় পায়, তাহলে পড়বে নচেৎ পড়বে না।
৭-মাসবূক ইমামের সাথে যেই রাকাআতে প্রবেশ করে, তা কি তার জন্য প্রথম রাকাআত?
অধিকাংশ ফুকাহায়ে কিরাম মনে করেন, মাসবূক যখন জামাআতে শরীক হয়, তখন তার সেটা নামাযের শেষাংশ হয়। আর যখন সে বাকিটা পূরণ করে সেটা তার প্রথমাংশ হয়। [ফিকহ বিশ্বকোষ ৩৭/১৬৪] উদাহারণ স্বরূপ যদি কোনো ব্যক্তি এমন সময় জামাআতে শরীক হয়, যখন ইমাম এক রাকাআত শেষ করে দ্বিতীয় রাকাআত পড়ছেন, তখন মাসবূকের এই রাকাআতটি তার জন্য প্রথম না দ্বিতীয়? হানাফী, মালেকী ও হাম্বালী ফুকাহাগণ এটাকে তার জন্য দ্বিতীয় রাকাআত মনে করেন, যেমন সেটা ইমামের জন্যও দ্বিতীয়। আর ইমামের সালাম ফিরানোর পর সে যা পড়বে তা তার প্রথম রাকাআত বা নামাযের শেষাংশ ধরা হবে। তাদের দলীল নবী (সাঃ) এর এই হাদীস “… যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে তা কাযা করে নিবে”। [নাসাঈ, ইমামাহ অধ্যায়, নং৮৬০] তারা এখানে কাযা শব্দটিকে ফেকহী পারিভাষিক অর্থে গ্রহণ করেন। অর্থাৎ কোন আমল তার নির্ধারিত সময়ে না করা হলে পরে তা করে দেওয়া। তাই ইমামের সাথে যেটা মাসবূক পায় নি সেটা তার প্রথম নামায ছিল যা নির্ধারিত সময়ে আদায় না হওয়ার কারণে পরে সে তা কাযা হিসাবে সম্পাদন করবে।
তবে শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহগণ মনে করেন, মাসবূক জামাআতে শরীক হয়ে ইমামের সাথে নামাযের যে প্রথম অংশটি পায় সেটা তার জন্য প্রথম রাকাআত এবং পরে সে যা পূরণ করে সেটি তার শেষ নামায বা নামাযের শেষাংশ। কারণ নবী (সাঃ) বলেনঃ “যখন নামাযে আসবে, তখন শান্ত ভাবে আসবে, যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে, তা পূরণ করে নিবে”। [বুখারী, অধ্যায়, আযান নং৬৩৫, ৬৩৬, মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং ১৩৬২]
এটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত কারণঃ
ক-নবী (সাঃ) এর বাণী ‘পূরণ করে নিবে’ থেকে বুঝা যায় যে, মুক্তাদী ইমামের সাথে যা পায় তা তার প্রথম রাকাআত। কারণ কোনো কিছু তখনই পূরণ হয়, যখন তা শুরু করা হয়। তাই নবী (সাঃ) যখন ছুটে যাওয়া নামায পূরণ করতে বলছেন, তখন এর অর্থ দাঁড়ায় যে, সে ইমামের সাথে যা পেয়েছে, তা তার প্রথম নামায।
খ-ইবনু মুনযির বলেনঃ তারা এ ব্যাপারে ঐক্যমত যে, তাকবীরে তাহরীমা প্রথম রাকাআত ছাড়া অন্য রাকাতে হয় না। [নায়লুল্ আউত্বার,৩/১৭১] তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা এইরূপ যে, মাসবূক যখন তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে নামাযে প্রবেশ করে, তখন তার সেটা প্রথম রাকাআত হওয়াই সঙ্গত কারণ; তাকবীরে তাহরীমা প্রথম রাকাআতেই হয়। এমন নয় যে, মাসবূক যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাকাআতে প্রবেশ করে, তখন সে তাকবীরে তাহরীমা দিবে না বরং যখন পূরণ করতে উঠবে তখন তাকবীরে তাহরীমা দিবে।
গ-বাকি থাকলো সেই বর্ণনা, যাতে কাযা করার শব্দ এসেছে তো তার উত্তর এই ভাবে দেওয়া হয়েছে।
১-কাযা করার বর্ণনা অপেক্ষা পূরণ করার বর্ণনা বেশী সংখ্যায় এসেছে এবং তা বেশী শুদ্ধ কারণ; এই বর্ণনা সহীহাইনে এসেছে।
২-হাদীসে কাযা শব্দটি ফুকাহাগণের পরিভাষায় ব্যবহার হয়নি কারণ তা পরে আবিষ্কৃত পরিভাষা; বরং তা কোনো কাজ পূরণ করা বা সমাপ্ত করার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (ফা-ইযা কুযিয়াতিস্ স্বালাতু) [জুমুআহ/১০] অর্থঃ ( যখন নামায সমাপ্ত হবে) তিনি অন্যত্রে বলেনঃ (ফা-ইযা কাযাইতুম মানাসিকাকুম) [বাকারাহ/২০০] অর্থঃ (অতঃপর হজ্জের কার্যাবলী যখন সমাপ্ত করবে)
এই মতভেদের ফলাফলঃ ধরুন যদি কেউ ইমামের সাথে মাগরিবের তৃতীয় রাকাআতে শরীক হয়, তাহলে প্রথম মতানুযায়ী সে শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ করবে কারণ; এটা তার তৃতীয় রাকাআত যেমন ইমামের ক্ষেত্রেও তৃতীয় রাকাআত। কিন্তু দ্বিতীয় মতানুযায়ী সে সূরা ফাতিহা সহ অন্য একটি সূরাও পাঠ করবে কারণ; এটি তার প্রথম রাকাআত। এই ভাবে বাকি বিষয়গুলি অনুমান করতে পারেন।
৮-রুকূ পেলে রাকাআত গণ্য করাঃ
মাসবূক ইমামের সাথে রুকূ পেলে সে সেই রাকাআতটি গণ্য করবে কি করবে না? অর্থাৎ তার সে রাকাআতটি হয়ে যাবে না হবে না? এ বিষয়ে ইসলামী বিদ্ব্যানদের দুটি মত দেখা যায়।
প্রথম মতঃ তার রাকাআত হয়ে যাবে এবং সে এটি রাকাআত ধরে নিবে। এই মতে সমস্ত ফুকাহদের ঐক্যমত রয়েছে। [ফিকহ বিশ্বকোষ ৩৭/১৬৩] তাদের দলীলাদি নিম্নরূপঃ
১-আবু বাকরা থেকে বর্ণিত, তিনি একদা লাইনে পৌঁছানোর পূর্বে রুকু করেন এবং ঝুকেই লাইনে প্রবেশ করেন। বিষয়টি নবী (সাঃ) কে বলা হলে তিনি (সাঃ) বলেনঃ “ আল্লাহ তোমার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিক আর পূনরায় এমন করো না”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং৭৮৩] তারা বলেনঃ নবী (সাঃ) তাকে সেই রাকাআতটি পুনরায় পড়ার আদেশ দেন নি, যা দ্বারা বুঝা যায় রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যায়।
‘পুনরায় করো না’ এর অর্থে ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহ) বলেনঃ দৌড়ে চলা এবং লাইনে প্রবেশের পূর্বে রুকূ করা অতঃপর সেই অবস্থায় ঝুকে হেঁটে লাইনে প্রবেশ করা, এমন কাজ আর করো না। তিনি ত্বাবারানীর বরাতে একথাও উল্লেখ করেন যে, নবী (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেনঃ এই নিঃশ্বাসী ব্যক্তি কে? (দৌড়ে দূর থেকে রুকূ করার কারণে তাঁর নিঃশ্বাস স্ফীত হয়ে গেছিল) তখন তিনি বলেনঃ আমার ভয় হচ্ছিল যে, আপনার সাথে রাকাআতটি পাব না”। [ফাতহুল বারী ২/৩৪৭] অর্থাৎ রাকাআতটি যেন ছুটে না যায় তাই তিনি এমন করেছিলে, যা থেকেও ইঙ্গিত মিলে যে, রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যায়। অনেকে বলেনঃ পুনরায় করো না, মানে লাইনের বাইরে তাকবীরে তাহরীমা দেওয়ার কাজটি আর করো না। কেউ বলেনঃ নামাযে আসতে ঢিলেমি করো না। রুকু অবস্থায় হেঁটে লাইনে প্রবেশ করো না কারণ; এটি চতুষ্পদ জন্তুর চলন। [নায়লুল আউত্বার, শাওকানী, ৩/২৩৬] রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যায়, মত পোষণকারীগণ উপরোক্ত অর্থগুলি থেকেও দলীল পেশ করে বলেনঃ কোনো অর্থের মাধ্যমে এটা বুঝা যায় না যে, নবী (সাঃ) তাকে পুনরায় সেই রাকাআতটি পড়তে বলেছেন, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যায়।
২-নবী (সাঃ) বলেনঃ “যে নামাযের এক রাকাআত পেল, সে নামায পেয়ে গেল”। [বুখারী, মাওয়াক্বীতুস স্বালাত, নং ৫৮০] অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন তোমরা নামাযে আসবে আর আমরা সাজদায় থকবো তখন তোমরাও সাজদা করো এবং তা গণ্য করো না। আর যে ব্যক্তি রাকাআত পেলো সে নামায পেয়ে গেল”। [আবু দাঊদ, বায়হাক্বী, আলবানী (রহ) যয়ীফ বলেছেন, ইরওয়া ২/২৬০]
আপত্তিঃ হাদীস থেকে রুকূ পেলে নামায পেলো, বা নামাযের ফযীলত পেলো, এটা বুঝা যায় কিন্তু রাকাআত পেলো তা বুঝা যায় না কারণ; তা উল্লেখ হয় নি।
উল্লেখ্য, (যে রুকূ পেল সে রাকাআত পেয়ে গেল) বলে আবু দাঊদের বরাতে যেই হাদীসটি বর্ণনা করা হয়, তা বর্তমান অনেক গবেষকের নিকট সাব্যস্ত নয়; যদিও বহু ফিকহ তথা অন্যান্য গ্রন্থে এমনই উল্লেখ হয়েছে।[দেখুন, সালেহ বিন মুহাম্মদ আল্ আমূদী কর্তৃক লিখিত প্রবন্ধ ‘তাহকীকুল খিলাফ ফী হাদীসে মান আদ্ রাকার রুকূ ফাক্বাদ আদ রাকার রাকাআহ’।www.majles.alukah.net এ প্রকাশিত]
৩-তাঁরা এছাড়া আরো কিছু সাহাবার আমল দ্বারা দলীল দিয়েছেন কিন্তু এসব বর্ণনা দোষ মুক্ত নয়।
দ্বিতীয় মতঃ রুকূ পেলে রাকাআত হবে না; বরং তাকে রুকূর পূর্বে কিয়াম অবস্থায় সূরা ফাতিহা পড়ার সুযোগ থাকতে হবে। এটি ইবনু হাযম সহ অনেকেরে মত।[আল্ মুহাল্লা, ইবনু হাযম ৩/২৪৪]
এই মতের দলীলাদিঃ
১-নবী (সাঃ) বলেনঃ “… যা পাবে তা পড়ে নিবে আর যা ছুটে যাবে তা পূরণ করে নিবে”।[বুখারী, অধ্যায়, আযান নং ৬৩৫, ৬৩৬, মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং ১৩৬২]
যে ইমামকে রুকূ অবস্থায় পায়, তার কিয়াম ছুটে যায়। তাই তাকে সালামের পর সেটা পূরণ করতে হবে।
২-কিয়াম নামাযের রুকন, যা ব্যতীত নামায হয় না। নবী (সাঃ) বলেনঃ “দাঁড়িয়ে নামায পড়, যদি না পারো তো বসে পড়, তাও না পারলে কাঁত হয়ে পড়”। [বুখারী, তাকস্বীরুস স্বালাত, নং ১১১৭]
বুঝা গেল, নামাযে দাঁড়ানো জরূরী তা বিনা ওজরে ছাড়া যাবে না। তাই রুকূ পাওয়া ব্যক্তির কিয়াম ছুটে যায় বলে তাকে সেই রাকাআত আবারো পড়তে হবে।
৩-নবী (সাঃ) বলেনঃ “ সূরা ফাতিহা পড়া ব্যতীত নামায হয় না”।[বুখারী, আযান অধ্যায়, নং৭৫৬]
বুঝা গেল, সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না। তাই রুকূ পাওয়া ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়েনি বলে তাকে পরে তা কাযা করতে হবে।
অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মত নির্ণয়ঃ প্রথম মতের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, ইমাম চতুষ্টয় সহ জমহূর উলামা আবু বাকরা (রাযিঃ) এর হাদীস থেকে রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যায় বুঝেছেন এবং এটি সঊদী স্থায়ী উলামা পরিষদও সমর্থন করেছেন। তাই তাঁদের বুঝের বিপরীতে কোন রায় দেওয়া আমার পক্ষে কষ্টকর। অন্য দিকে নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ এবং কিয়ামের গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য করলে রুকু পাওয়া ব্যক্তির রাকাআত হওয়া মেনে নেওয়াতে একটু কিন্তু থেকেই যায়। তবে উভয় মত দলীল দ্বারা সমাদৃত হওয়ায় দুটির প্রতি আমল করা সঙ্গত হবে ইনশা আল্লাহ।
৯-জুমআর এক রাকাআত নামায ছুটে গেলেঃ
যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকাআত নামায পেয়েছে, সে জুমআ পেয়েছে। এই সময় সে ইমামের সালামের পর বাকি এক রাকাআত পূরণ করে নিবে। নবী (সাঃ) বলেনঃ “ যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকাআত পেল, সে যেন আর এক রাকাআত মিলিয়ে নেয় এবং তার সালাত পূর্ণ”। [নাসাঈ নং ৫৫৭, ইবনু মাজাহ নং ১১২১, সূত্র সহীহ, ফাতাওয়া লাজনা দাইমাহ ৮/২২৪]
আর যে ব্যক্তি এক রাকাআতের কম পেয়েছে, যেমন দ্বিতীয় রাকাআতের সাজদা বা তাশাহ্হুদ পেয়েছে, তাহলে সে জুমআর সালাত পায় নি। এমতাবস্থায় সে ইমামের সালাম শেষে উঠে চার রাকাআত যহরের নামায আদায় করবে। [সউদী স্থায়ী ফাতাওয়া বোর্ড ৮/২২৭]
১০-ঈদের নামাযের মাসবূকঃ
ঈদের নামাযে প্রথম রাকাআতে ইমামের অতিরিক্ত তকবীর দেওয়ার সময় কেউ জামাআতে প্রবেশ করলে, প্রথমে সে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে নামাযে প্রবেশ করবে। এই সময় যদি সে কিছু তকবীর ইমামের সাথে পায় তো দিবে নচেৎ বাকি কাজে ইমামের অনুসরণ করবে। নামায শেষে এই অতিরিক্ত তাকবীর (তাকবীরে যাওয়াঈদ) তাকে পূরণ করতে হবে না। [মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনু উসায়মীন,১৬/২৪৫]
আর কেউ যদি দুই ঈদের দ্বিতীয় রাকাআতের তাশাহ্হূদে শরীক হয়, তাহলে সে ইমামের সালাম ফিরানোর পর ইমামের মতই তকবীর, কিরাআত, রুকূ ও সাজদা করে দুই রাকাআত নামায আদায় করবে। [সঊদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড ৮/৩০৭] এই ভাবে এক রাকাআত ছুটে গেলেও অনুরূপ পদ্ধতিতে আদায় করবে।
১১-জানাযার নামাযের মাসবূকঃ
যদি কেউ এমন অবস্থায় জানাযার নামাযে শরীক হয় যখন ইমাম একটি তাকবীর শেষ করে দ্বিতীয় তাকবীরে আছেন বা দ্বিতীয় শেষ করে তৃতীয়তে অবস্থান করছেন বা তৃতীয় শেষ করে চতুর্থের স্থানে রয়েছেন। তাহলে সে ইমামের সাথে যত তাকবীর পাবে তার অনুসরণ করতঃ আদায় করবে এবং ইমামের সালাম ফিরানোর পর এবং জানাযা উঠানোর পূর্বে সে বাকি তাকবীরগুলি দিয়ে সালাম ফিরাবে। কাযা তকবীরগুলি
আদায় করার সময় তার উপর সর্বনিম্ন যা জরুরী তা করলেই যথেষ্ট হবে। যেমন দ্বিতীয় তাকবীরে যদি বলে, আল্লাহুম্মা সাল্লি আ’লা মুহাম্মদ (হে আল্লাহ! নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করো) এবং তৃতীয়ের পর যদি বলেঃ ‘আল্লাহুম্মাগ্ ফির লাহু’ (হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করো), তাহলে তা যথেষ্ট হবে। [সঊদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড,৮/৩৯৯]
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
আরও পড়ুন: