ইমাম ও ইমামতি (শেষ পর্ব-৯)
লেখক: আব্দুর রাকীব (মাদানী)
ফরয নামাযান্তে ইমাম ও মুক্তাদীদের হাত তুলে সম্মিলিত ভাবে দুয়া করা
আল্ হামদু লিল্লাহি রাব্বিল্ আলামীন, ওয়াস্ স্বালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বাদঃ
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিষয়টি বহু প্রাচীন এবং এ সম্পর্কে বিগত উলামাগণ যথেষ্ট লেখা-লেখি ও করেছেন। কিন্তু যেহেতু বিষয়টির সম্পর্ক আমাদের আলোচ্য বিষয় ইমাম ও ইমামতির সাথে রয়েছে তাই কিছু আলোচনা করা সঙ্গত মনে করছি। ওয়া মা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।
১–সমাজের সাধারণ লোকদের এই দুয়া সম্পর্কে ধারণাঃ
যেই সমাজে এই দুয়ার প্রথা রয়েছে সেখানকার লোকেরা এই দুয়া সম্পর্কে যে ধারণা ও বিশ্বাস রাখে তার সামান্য বর্ণনা নিম্নে তুলে ধরলাম।
- যেখানে এই দুয়ার প্রথা চালু আসে সেখানে কোনো কারণে কাউকে যদি ইমামতি করতে হয় এবং ইমাম সালাম শেষে দুয়া না শুরু করে, তাহলে পিছনের মুসল্লারা দুয়ার অপেক্ষায় থাকে। অনেক সময় মুক্তাদীদের কেউ আদেশ কিংবা আবেদনের সুরে বলেই দেয়, দুয়া করে দিন। ভাবটা এমন যে, এই দুয়া তারা নিজে করতে পারে না ইমামের নেতৃত্বেই করতে হবে এবং এই কাজ ব্যতীত যেন তাদের নামায শেষ হয় নি, তাই তারা সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে অপেক্ষায় রয়েছে।
- অনেক স্থানে কোনো ইমাম নিয়মিত দুয়া না করার কারণে ইমামতি হারায়। অর্থাৎ আপনি এই সম্মিলিত দুয়াকারী হলেই তাদের ইমাম হতে পারেন; নচেৎ নয়। তাদের এই আচরণে এটাই প্রকাশ পায় যে, তারা এই কাজকে খুবই গুরুত্ব দেয় এবং তা না করলে তার পিছনে নামায আদায় করে না।
- অতঃপর দুয়া না করে কোনো ইমাম যদি সুন্নত নামায শুরু করে দেয় কিংবা মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে শুরু হয় মন্তব্যের পর মন্তব্য। এটা কেমন ইমাম নামাযের পর মুনাজাতই করলো না! একে কে ইমাম বানালো? দুয়া করা কি অপরাধ? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি দুয়া করতেন না? আল্লাহ তাআলা কি কুরআনে দুয়া করতে বলেন নি? দুয়া করলে ক্ষতিটা কি? কেউ আবার উপমা পেশ করে বলেঃ এই ইমাম ভাত খাওয়ালো কিন্তু পানি খাওয়ালো না। ইত্যাদি মন্তব্য যার অনেকেটা অবান্তর ও বিরক্তকরও বটে।
- কোথাও আবার বাহ্যত সম্মিলিত দুয়ার প্রথা নেই কিন্তু কৌশলে সেই প্রথা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। তাই কেউ ফরমাইশ করে বলেঃ অমুক সমস্যা রয়েছে, তমুক অসুস্থ, কিছু না পেলে সবসময়ের সমস্যা উল্লেখ করে বলেঃ বর্তমান বিশ্বে মুসলিমদের অবস্থা শোচনীয় তাই দুয়া করে দিন। কেউ যেন তাদের শিক্ষা দিয়েছে যে এমনি এমনি এই রকম দুয়া ঠিক নয় কিন্তু ফরমাইশী দুয়া (আবেদনের দুয়া) ঠিক আছে।
যাই হোক উপরোক্ত সকলের কথা ও ভাবে এটা স্পষ্ট হয় যে, তারা এই দুয়ার একটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অনেকে এটাকে নামাযের একটি অংশও মনে করে থাকে, তা না করলে নামাযের ঘাটতি মনে করে। কম পক্ষে বলতে পারেন, তারা এমন করাকে ভাল মনে করে।
এখন প্রশ্ন হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি এমন করতেন; অথচ তিনি নামায ফরয হওয়ার পর সারা জীবন ইমামতি করেছেন? এমন করার প্রথা কোনো সাহাবী কি বর্ণনা করেছেন; অথচ তারা বহু সংখ্যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুকরণে তাঁর পিছনে নামায আদায় করেছেন? এমন একটি ইবাদত যা দিন-রাতে পাঁচবার আদায় করা হয়, তাতে এমন দুয়ার নিয়ম থাকলে তাঁরা কি বর্ণনা করতেন না? আর যদি এই নিয়মেই না থাকে, তাহলে আমাদের এমন করা দ্বীনে নতুল আমল সৃষ্টি করা নয় কি?
২–সালাম শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করতেনঃ
মহান আল্লাহ বলেনঃ (যখন তোমরা নামায আদায় করে নিবে, তখন দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহর যিকর করবে) [সূরা নিসা/১০৩] অনুরূপ মহান আল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত শেষে তাঁর যিকর করার আদেশ করেন। যেমন রামাযানের সিয়াম শেষে [সূরা বাকারাহ/১৮৫] এবং হজ্জ সম্পাদন শেষে। [বাকারাহ/২০০]
তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায শেষে বেশী বেশী যিকর-আযকার করতেন, যার বিস্তারিত বর্ণনা হাদীসের গ্রন্থসমূহে এবং সীরাতে বর্ণিত হয়েছে।
দ্বীনের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়ের বিশিষ্ট গবেষক বাকর আবু যাইদ (রাহেঃ) বলেনঃ ‘ফরয নামাযের সালামের পর সুন্নত হচ্ছে, কতিপয় যিকর সামান্য সশব্দে করা সমূহ যিকর সশব্দে নয়, দুয়া করা, কুরআনুল কারীম থেকে যা বর্ণিত তা পাঠ করা… এবং সুন্নত হচ্ছে প্রত্যেক মুসল্লীর নিজে নিজে এসব করা’। [তাস্বহীহুদ্দুআ/৪৩৮] অতঃপর তিনি সহীহ বর্ণনার আলোকে সেগুলি তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য যে, যিকর এমন শব্দ ও বাক্যকে বলে যা দ্বারা আল্লাহর মহত্ব, বড়ত্ব এবং তাঁর গুণগান করা হয়। আর দুয়া এমন শব্দ বা বাক্যকে বলা হয়, যার মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা হয়, তাঁর নিকট প্রার্থনা করা হয়, তাঁর কাছে আবেদন করা হয়। কোনো কোনো সময় দুটি এক অপরের অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
ক–নামায শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যিকরের বর্ণনাঃ (সংক্ষিপ্তাকারে)
- তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাম ফিরানোর পর তিন বার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলতেন। অতঃপর বলতেনঃ “ আল্লাহুম্মা আনতাস্ সালাম ওয়া মিনকাস্ সালাম, তাবারাকতা ইয়া যাল্ জালালি ওয়াল্ ইকরাম”। [সহীহ মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায় নং ৫৯১] তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সময় কিবলামুখী হয়ে প্রায় ততক্ষণ থাকতেন যতক্ষণ উপরোক্ত যিকর বলতে সময় লাগে। তার পর মুসাল্লীদের দিকে মুখ করে ফিরে বসতেন। [যাদুল্ মাআ’দ,১/২৯৫]
- সহীহাইনের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায শেষ করার পর বলতেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্ দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল্ মুলকু ওয়ালাহুল্ হামদু ওহুআ আলা কুল্লি শায়ইন্ ক্বাদীর। আল্লাহুম্মা লা মানিআ লিমা আ’ত্বায়তা ওয়া লা-মুত্বিয়া লিমা মানা’তা, ওয়ালা ইয়ানফাউ যাল্ জাদ্দি মিনকাল্ জাদ্দু”। [বুখারী, নামাযের নিয়ম অধ্যায়, নং ৮৪৪/মুসলিম, নং ৫৯৩]
- আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাযিঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক নামাযের শেষে যখন সালাম ফিরাতেন, তখন এই বাক্যগুলি বলতেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল্ মুলকু, ওয়া লাহুল্ হামদু ওয়া হুআ আলা কুল্লি শায়ইন ক্বাদীর। লা হাওলা ওয়ালা কুওআতা ইল্লা বিল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ … ওয়া লাও কারিহাল কাফিরূন” পর্যন্ত। [সহী মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং ৫৯৪]
- অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল্ হামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার এবং ১০০ পূরণে বলতেনঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহূ, লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়ালাহুল্ হামদু, ওয়া হুআ আলা কুল্লি শায়ইন ক্বাদীর। [মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং ৫৯৭] এই তাসবীহ পাঠের আরো ৫টি পদ্ধতি প্রমাণিত। [দেখুন, তাস্বহীহুদ দুয়া পৃঃ ৪৩২ এবং যাদুল মাআদ, ১/২৯৮-২৯৯]
খ–নামায শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক কুরআনের কিছু অংশ ও সূরা পড়ার বর্ণনাঃ
- আয়াতুল্ কুরসী পাঠ করাঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পশ্চাদে আয়াতুল্ কুরসী পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশ করা থেকে মৃত্যু ব্যতীত কোনো কিছু বাধা হবে না” [নাসাঈ, নং ৯৯২৮, তারগীব ও তারহীব, ২/২৬১, ইবনু হিব্বান]
- সূরা ইখলাস, সুরা ফালাক্ব এবং সূরা নাস পাঠ করাঃ উক্ববা বিন আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন যেন আমি প্রত্যেক নামাযের পশ্চাদে মুআব্বিযাত (আশ্রয় চাওয়ার সূরাসমুহ যথাক্রমে ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস) পাঠ করি। [মুসনাদ আহমদ ৪/২১১, আবু দাঊদ নং (১৫২৩), ইবনু হিব্বান (২৩৪৭), তিরমিযী (২৯০৫) তবে তাতে কেবল সূরা নাস ও ফালাক উল্লেখ হয়েছে]
গ–নামাযান্তে সালামের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে দুয়ার প্রমাণঃ
- আবু উমামাহ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ কোন্ দুয়া বেশী কবূল হয়? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “রাতের শেষাংশে এবং ফরয নামাযের পশ্চাদে।”। [তিরমিযী, অধ্যায় দাআওয়াত, অনুচ্ছেদ নং ৭৯, হাদীস নং (৩৪৯৯] হাদীসটিকে স্বয়ং ইমাম তিরমিযী হাসান বলেছেন এবং শাইখ আলবানীও হাসান বলেছেন]
- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়ায (রাযিঃ) কে অসিয়ত করেন, সে যেন প্রত্যেক নামাযের পশ্চাদে বলেঃ “আল্লাহুম্মা আইন্নী আলা যিকরিকা ওয়া শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদাতিকা”। অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনার যিকর, আপনার কৃতজ্ঞতা এবং আপনার উত্তম ইবাদত করতে আমাকে সাহায্য করুন। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, ইস্তিগফার অনুচ্ছেদ নং (১৫২২), নাসাঈ, সূত্র সহীহ, ইবনু হিব্বান (২৩৪৫)] উল্লেখ্য যে, মুআয (রাযিঃ) কে অসিয়তকৃত বাক্যগুলি দুয়া’র বাক্য।
- আবু দাঊদ সহীহ সূত্রে আলী বিন আবী ত্বালিব (রাযিঃ) হতে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামাযে সালাম ফিরাতেন, তখন বলতেনঃ “আল্লাহুম্মাগ্ ফির্ লী মা কাদ্দাম্তু ওয়া মা আখ্খারতু, ওয়া মা আসরারতু, ওয়া মা আ’লানতু, ওয়া মা আসরাফতু, ওয়া মা আন্তা আ’লামু বিহী মিন্নী, আন্তাল্ মুকাদ্দিমু ওয়া আন্তাল্ মুআখ্ খিরু, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা”। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ সালাম ফিরানোর পর মানুষ যা বলবে, সূত্র সহীহ, তিরমিযী দাআওয়াত নং (৩৪১৯)] অর্থঃ “হে আল্লাহ! আমি যে সব গুনাহ অতীতে করেছি, পরে করেছি, গোপনে করেছি, প্রকাশ্যে করেছি, সীমালঙ্ঘনে করেছি, তা তুমি মাফ করে দাও। মাফ করে দাও আমার সেই সব গুনাহ যা তুমি আমার অপেক্ষা বেশী জানো, তুমি যা চাও আগে কর এবং যা চাও পিছে কর, তুমি ছাড়া উপসনাযোগ্য কোনো সত্য মা’বূদ নেই”।
- ইবনুল ক্বায়্যিম (রাহেঃ) উপরোক্ত দুয়াটির সম্পর্কে সহীহ মুসলিমের বরাতে বলেনঃ মুসলিমের বর্ণনানুযায়ী দুটি শব্দ এসেছে। এক, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা তাশাহ্হূদ ও সালামের মাঝে বলতেন। দুই, সালামের পর বলতেন। অতঃপর তিনি উভয়ের সমন্বয় করতঃ বলেনঃ মনে হয়, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় স্থানে বলতেন। [যাদুল মাআদ,১/২৯৭]
- ইমাম বুখারী কিতাবুত্ দাআওয়াতে, নামাযের পরে দুয়া করা শিরোনামে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এবং বুখারীর ভাষ্যকার ইবনু হাজার এই অনুচ্ছেদ সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেনঃ এই অনুচ্ছেদ তাদের খণ্ডন করে, যারা মনে করে যে, নামাযের পর দুয়া করা বৈধ নয়। [ফাতহুল বারী,১১/১৫৯]
উপরোক্ত দলীল-প্রমাণের আলোকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ফরয নামাযে সালামের পর দুয়া করা বৈধ। কিন্তু তা হাত তুলে করতে হবে না সম্মিলিত ভাবে করতে হবে, এর প্রমাণ উপরোক্ত দলীল সমূহে উল্লেখ হয় নি।
উল্লেখ্য যে, ইমাম ইবনু তাইমিয়া হাদীসে উল্লেখিত শব্দ (দুবুরুস্ স্বালাত) নামাযের পশ্চাদে দুয়া করা বলতে নামাযের শেষাংশে সালামের পূর্বে তাশাহ্হুদে দুয়া করা মনে করেছেন। অর্থাৎ ঐসকল দুয়া নামাযের ভিতরে হবে নামাযের পরে নয়। তাঁর মন্তব্য হল, দুবুর (পশ্চাদ) শব্দটি কবুল (সম্মুখ) এর বিপরীত। আর কোনো কিছুর দুবুর বলতে সেই বস্তুর পশ্চাদ বুঝায়, যা তার সাথে মিলিত থাকে তা থেকে পৃথক থাকে না। যেমন মানুষের পশ্চাদ বা পাছা, যা মানুষের সাথেই মিলিত, মানুষ থেকে পৃথক নয়। তাই নামাযের পশ্চাদে দুয়া করা অর্থ হবে নামাযের শেষাংশে দুয়া করা, নামায শেষ করার পর নয়। কারণ সালামের পর দুয়া করলে দুয়া নামাযের বাইরে হয়, নামাযের পশ্চাদে হয় না। কিন্তু তাঁর এই মত সরাসরি গ্রহণীয় নয় কারণ; দুবুর (পশ্চাদ) শব্দটির অর্থ যেমন সেই বিষয়ের পাছা বুঝায়, যা তার সাথে মিলিত থাকে, তেমন কোনো কিছুর পশ্চাদ বুঝায়, যা তা থেকে পৃথক থাকে। ইবনু হাজার (রহ) বলেনঃ ‘আমরা বলেছি প্রত্যেক নামাযের (দুবুরে) পশ্চাদে যিকরের আদেশ এসেছে। আর এর অর্থ সর্বসম্মতিক্রমে সালামের পর’। [ফাতহুল বারী,১১/১৬০] অর্থাৎ তিনি বলতে চাচ্ছেন, নামাযের পর যে যিকর সমূহ করতে বলা হয়েছে, তাতেও দুবুরুস্ স্বালাত (নামাযের পশ্চাদে) শব্দটি এসেছে এবং উলামাদের ঐক্যমতানুযায়ী এখানে দুবুর অর্থ নামাযের পর। তাই দুয়া যেমন নামাযের শেষাংশে সালামের পূর্বে করা বৈধ তেমন নামায শেষে সালামের পরেও করা বৈধ।
৩–কোনো সময়ে বা স্থানে দুয়ার প্রমাণ থাকলেই কি হাত তুলে দুয়া করা বৈধ হয়?
আমরা অনেকে মনে করি যে, কোথাও দুয়ার প্রমাণ থাকলেই মনে হয়, হাত তুলে দুয়া করতে হয় বা তুলা বৈধ হয়। দুয়ার প্রমাণ যেহেতু আছে, তাই হাত তুলে দুয়া করলে অসুবিধা কি? তাছাড়া সমাজে অনেকের নিকট দুয়া মানে হাত তুলে চাওয়া। হাত না তুলেই আল্লাহর নিকট চাওয়া যায়, এটা তাদের ধারণাই নেই। অতঃপর দুয়ার প্রমাণ পেলেই হাত তুলার পক্ষে সেই আম হাদীসও দলীল হিসাবে পেশ করা হয় যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ অবশ্যই তোমাদের রব্ব লজ্জাশীল, ত্রুটি গোপনকারী, বান্দা যখন দুই হাত তুলে তার নিকট চায়, তখন তিনি তাদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জা করেন”।[তিরমিযী নং ৩৫৫৬]
আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বহু স্থানে ও বিভিন্ন সময়ে দুয়ার প্রমাণ এসেছে কিন্তু তিনি এসব ক্ষেত্রে অনেক স্থানে হাত তুলেছেন আর অনেক স্থানে তুলেন নি। তাই তাঁর সুন্নতের প্রতি আমল করতে হলে, আমাদের সেই সব স্থানে হাত তুলা উচিৎ যেখানে তিনি তুলেছেন আর যেখানে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলেন নি সেখানে না তুলাই সুন্নাহ। নিম্নে কিছু এমন সময় ও স্থানে দুয়ার বর্ণনা দেওয়া হল, যেখানে দুয়া প্রমাণিত কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়ঃ
- অযু শেষে দুয়া করা প্রমাণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাহাদাতাইন পাঠ করতেন এবং বলতেনঃ “হে আল্লাহ! আমাকে তাওবা কবূলকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের দলভুক্ত করো”। [মুসলিম (২৩৪) তিরমিযী (৫৫)] কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ স্থানে দুই হাত তুলে সেই দুয়া করতেন না।
- তাওয়াফ করার সময় দুয়া করা প্রমাণিত, বিশেষ করে রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মাঝে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেনঃ (হে আমাদের রব্ব! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও , আখেরাতে কল্যাণ দাও এবং জাহান্নামের আযাব থেকে পরিত্রান দাও)। [বাক্বারা/২০১] কিন্তু তিনি এখানে হাত না তুলেই এই দুয়া করতেন।
- জুমআর খুতবায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দুয়া করা প্রমাণিত, কিন্তু তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাতে হাত তুলে দুয়া করতেন না।[মুসলিম, নং ৮৭৪] তবে এই সময় ইস্তিসকার (বৃষ্টির জন্য দুয়া-প্রার্থনা) করলে তিনি দুই হাত তুলে দুয়া করতেন। [বুখারী, ইস্তিসক্বা অধ্যায়, নং ৯৩৩]
- সফর শুরু করার সময় এবং বাহনে আরোহণকালে দুয়া করা প্রমাণিত কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বাহনে পা রাখতেন তখন বিসমিল্লাহ বলতেন। আর আরোহণ করলে বলতেনঃ আল্ হামদু লিল্লাহিল্লাযী সাখ্খারা লানা.. [তিরিমিযী নং৩৪৪৩) আরো বলতেনঃ আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফী সাফারিনা হাযা… [মুসলিম হাজ্জ অধ্যায় নং ১৩৪২]
- নামাযের মধ্যেই রুকু, সাজদা এবং তাশাহ্হুদে দুয়া প্রমাণিত কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়। আরো ও বহু স্থানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে দুয়া প্রমাণিত কিন্তু হাত তুলা অপ্রমাণিত যেমন, মসজিদে প্রবেশের সময় এবং বের হওয়ার সময় দুয়া, বাড়িতে প্রবেশ কালে এবং বের হওয়ার সময় দুয়া, শৌচালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় দুয়া, বিছানায় ঘুমাবার পূর্বে দুয়া এমন কি স্ত্রী সহবাসের সময় দুয়া। এসব স্থানে দুয়া প্রমাণিত কিন্তু হাত তুলা প্রমাণিত নয়।
তাই এমন মত পোষণ করা ভুল যে, ফরয সালামান্তে যেহেতু দুয়ার প্রমাণ রয়েছে তাই হাত তুলে দুয়া করা যায় বা করা ভাল। কারণ এটি একটি দুয়ার এমন স্থান যাতে দুয়ার প্রমাণ তো রয়েছে কিন্তু হাত তুলার প্রমাণ নেই। যেমন উপরোক্ত একাধিক প্রমাণে একাধিক স্থানে দুয়া করা সাব্যস্ত কিন্তু হাত তুলা সাব্যস্ত নয়।
শাইখ সালিহ ফাউযান (হাফেঃ) বলেনঃ “অতঃপর এই যিকর সমূহ শেষ করার পর চুপি চুপি যা ইচ্ছা দুয়া করবে। কারণ এমন ইবাদতের পর এবং এসব মহান যিকরের পর দুয়া বেশী কবূল হওয়ার সম্ভাব্য স্থান। অতঃপর ফরয নামায শেষে দুয়ার সময় দুই হাত তুলবে না, যেমন অনেকে করে; কারণ এটি বিদআত। এটা কখনো কখনো নফলের পর করা যায়”। [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিক্বহী/৭৯]
৪–কোনো সময়ে বা স্থানে দুয়ার প্রমাণ থাকলেই কি সম্মিলিত ভাবে দুয়া করা বৈধ হয়?
আমরা যখন উপরোক্ত আলোচনায় বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, দুয়ার প্রমাণ থাকলেই হাত তুলা বৈধ হয় না, তখন বর্তমান প্রসঙ্গ বুঝতে আশা করি সহজ হবে যে, কোথাও দুয়ার প্রমাণ থাকলেই তা সম্মিলিত ভাবে করা বৈধ হবে না; যতক্ষণে সম্মিলিত আকারে করার প্রমাণ না পাওয়া যায়। উদাহারণ স্বরূপ জুমআর খুত্ববায় দুয়া করা। এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় সব খুত্ববাতে দুয়া করতেন কিন্তু তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত তুলতেন না আর না নামাযীগণ তুলতেন। কিন্তু এই স্থানেই যখন ইস্তিসকা তথা বৃষ্টি চাওয়ার দুয়া করলেন, তখন তিনি ও উপস্থিত সাহাবীগণ সকলে হাত তুলে দুয়া করলেন। তাই যেখানে ও যেই সময়ে তিনি সম্মিলিত ভাবে দুয়া করলেন, আমাদের সেখানে সম্মিলিত আকারে করা সুন্নত আর যেখানে তিনি একা একা করলেন সেখানে একা একাই করা সুন্নত।
একটি আরোও সুস্পষ্ট উদাহারণ উল্লেখ করা ভাল মনে করছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজারো সাহাবীকে সাথে নিয়ে হজ্জ পালন করছেন এবং বলছেন “তোমরা আমার কাছ থেকে হজ্জের নিয়ম জেনে নাও” [মুসলিম১২৯৭] এই হজ্জ পালনের সময় তিনি বহু স্থানে দুয়া করেছেন। তন্মধ্যে ৬য় স্থানে তাঁর হাত তুলার প্রমাণ এসেছে। ১-সাফাতে ২-মারওয়াতে ৩-আরাফার দিনে সন্ধায় ৪-মুযদালিফায় ফজরের পর ৫- তাশরীকের দিনগুলিতে ছোট জামরায় পাথর মারার পর ৬- মধ্যম জামরায় পাথর মারার পর। [তাস্বহীহুদ দুয়া/৪৩৭]
লক্ষণীয় হচ্ছে, উক্ত স্থান সমূহে দুয়ার প্রমাণ রয়েছে এবং হাত তুলারও প্রমাণ রয়েছে কিন্তু সম্মিলিত ভাবে দুয়ার প্রমাণ মিলে না; অথচ সাহাবাদের একটি বড় সংখ্যা তাঁর সাথে রয়েছেন। না নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে নিয়ে দুয়া করছেন আর না সাহাবাগণ তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক হয়ে আমীন আমীন বলছেন। যা দ্বারা বুঝা যায় যে, দুয়া করার সময় ও স্থান এবং তাতে হাত তুলার প্রমাণ থাকলেও সম্মিলিত রূপ দেওয়া বৈধ নয়। যেমন আমাদের অনেক অজ্ঞ ভাই বিশেষ বিশেষ সমাবেশের সময় বলে থাকেঃ বহু লোকের সমাগম হয়েছে আল্লাহ কারো না কারো দুয়া কবূল করবে তাই দুয়া করে দিন বা এই ধরণের অন্য যুক্তি। অথচ এসব বৈঠক ও সমাবেশ দুয়া কবূলের স্থান হিসাবে প্রমাণিত নয়। আর তা না হলে হাত তুলে দুয়া করা ও সম্মিলিত ভাবে করা দূরের প্রশ্ন।
যারা এসব ক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে ফরমায়েশী দুয়ার আবেদন করে হাত তুলে সম্মিলিত দুয়া করেন, তাদের জন্যও একটি নববী সুন্নত পেশ করতে চাই। এসব সাধারণ অবস্থা নয় বরং জিহাদ-কিতালের সময় হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় ৩১৪ জন সাহাবীকে সাথে নিয়ে বদর প্রাঙ্গনে হাজির হয়েছেন। শত্রুদের সংখ্যা হাজারেরও অধিক। তাদের যুদ্ধ সরঞ্জামও অনেক বেশী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে মহান আল্লাহর নিকট অতি কাকুতি-মিনতি সহকারে দুয়া করেন। তিনি তার দুয়ায় বলেনঃ হে আল্লাহ! ইসলামের এই গোষ্ঠী যদি আজ ধ্বংশ হয়ে যায়, তাহলে তোমার জমিনে ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না। এই দুয়ার এমনই অবস্থা ছিল যে, তাঁর কাঁধ থেকে চাদর পড়ে যায়। এই সময় আবু বাকর (রাযিঃ) চাদর তুলে আল্লাহর রাসূলের কাঁধ ঢেকে দেন এবং বলেনঃ হে আল্লাহর নবী! যথেষ্ট হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহ আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করবেন। [বুখারী ও মুসলিম]
বলুন তো এমন অবস্থাতেও কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সাথে নিয়ে দুয়া করলেন? আর না সাহাবাগণ পিছন থেকে এসে তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক হলেন? এমন কি আবু বাকর পাশে থাকা সত্ত্বেও কি তাঁর সাথে দুয়ায় শরীক হলেন? আর না কেউ ফরমাইশ করল যে, কাল যুদ্ধ তাই একটু দুয়া করে দিন। তাই বলছিলাম ছোট-খাট অজুহাতকে কেন্দ্র করে সম্মিলিত দুয়ার অভ্যাসও পরোক্ষভাবে বিদআতী দুয়ারই অন্তর্ভুক্ত।
৫–ফরয নামায শেষে দুয়ার দলীলগুলির অবস্থাঃ
যারা ফরয নামায শেষে সম্মিলিত দুয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন, তারা কিছু দলীল পেশ করে থাকেন। কিন্তু সত্যিকারে সে সব দলীল মূলতঃ দলীল নয়; কারণ হয় সেগুলো জাল, যয়ীফ কিংবা সে সবের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। নিম্নে ঐসব প্রমাণের কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলঃ
ক-আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর হতে বর্ণিত, তিনি এক ব্যক্তিকে নামায শেষ করার পূর্বে দুই হাত তুলে দুয়া করতে দেখেন। যখন সে নামায শেষ করে, তখন তিনি তাকে বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই হাত নামায শেষ করার পূর্বে তুলতেন না। [ত্বাবারী, মুজাম আল কাবীর, ১৩/১২৯]
কিন্তু হাদীসটি যয়ীফ কারণ; বর্ণনাকারীদের মধ্যে মুহাম্মদ বিন আবী ইয়াহইয়া ও আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাযিঃ) এর মধ্যে সূত্র বিচ্ছিন্ন (মুনকাত্বা)। তাছাড়া ইবনু আবী ইয়াহইয়াকে ঐক্যমতানুযায়ী প্রত্যাখ্যাত (মাতরূক) রাবী বলা হয়েছে এবং তার থেকে বর্ণনাকারী ফুযাইল বিন সুলাইমান নামক অপর রাবীর স্মরণশক্তি ও দুর্বল প্রকৃতির। তাই হাদীসটি সূত্র বিচ্ছিন্নতা এবং দুর্বলতার দোষে দুষণীয়। তাছাড়া সেই হাত তুলা নফল না ফরযান্তে হবে তাও বর্ণিত হয় নি। আর না তাতে সম্মিলিত দুয়ার কথা আছে।
খ-ইয়াযীদ বিন আসওয়াদ আল্ আমেরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ফজরের নামায আদায় করলাম। যখন তিনি সালাম ফিরালেন, মুখ ফিরে বসলেন এবং দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন।” [ইলাউস সুনান, ৩/২০৭]
পর্যালোচনাঃ উপরোক্ত হাদীসের শেষাংশ আন্ডার লাইন করা হয়েছে, “এবং দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন।” এই বাক্যটি হাদীসের মূল গ্রন্থে নেই। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ বই ইলাউস্ সুনান সহ অন্য মুতাআখ্খির বইতে বাক্যটি আছে। কিন্তু হাদীসের মূল গ্রন্থ যা থেকে হাদীসটি সংকলন করা হয়েছে, তাতে এই বর্ধিত বাক্য নেই। আর এই বর্ধিত বাক্য না থাকলে হাদীসটি নামাযের পর একা বা সম্মিলিত ভাবে হাত তুলে দুয়া করার প্রমাণই হতে পারে না। হাদীসটির মূল গ্রন্থ হচ্ছে মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা। আর তাতে দুই হাত তুললেন এবং দুয়া করলেন বাক্যটি নেই। [বর্ধিত অংশ ছাড়াই হাদীসটি দেখুন, আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ সালামের পর ইমাম ঘুরে বসবে, নং ৬১০/মুসনাদ আহমদ ৪/১৬০-১৬১, ইবনু আবী শায়বা, ১/৩০২ ও ১৪/১৮৬]
অনেকে এটা সালাম শেষে দুয়ার গোঁড়া সমর্থকদের কারচুপি মনে করেন, যারা নিজ মতের সমর্থনে হাদীসে কারচুপি পর্যন্ত করেন। উপরোক্ত বর্ণনাটির সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা স্বাহীহ ত্বারীকায়ে নামায, রাইস নাদভী, পৃঃ ৫৪৩-৫৪৭ এবং তাস্বহীহুদ দুয়া পৃঃ ৪৪১।
গ-ফযল বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ নামায দুই দুই রাকাআত, প্রত্যেক দুই রাকাআতে তাশাহ্হূদ হবে। বিনয়, বিনম্রতা, অসহায় প্রকাশ পাবে এবং দুই হাত তুলতে হবে। অতঃপর বর্ণনাকারী বলেনঃ তুমি উভয় হাতকে মহান রব্বের দিকে এমন ভাবে তুলবে যেন, হাতের অভ্যন্তরীন ভাগ চেহারার দিকে থাকে এবং বলবেঃ হে আমার রব্ব! হে আমার রব্ব! আর যে এমন করবে না, তার নামায এমন হবে এবং এমন হবে।” [তিরমিযী, স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ২৭৯, হাদীস নং ৩৮৩]
পর্যালোচনাঃ তুহফাতুল্ আহওয়াযীর লেখক মুবারকপূরী বলেনঃ এই হাদীসটি আব্দুল্লাহ বিন নাফি বিন ইবনুল উমইয়ার উপর ভিত্তিশীল। আর সে অজ্ঞাত রাভী যেমন হাফেয বলেছেন। ইমাম বুখারী বলেনঃ তার হাদীস স্বহীহ নয়। ইবনে হিব্বান তাকে আস্ সিক্বাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন”। [তুহফাতুল আহওয়াযী, ২/৩২৮] তাছাড়া হাদীসটি সহীহ হলেও তা নফল তথা রাতের নামাযকে বুঝায়; কেন না তাতে দুই দুই রাকাআতের বর্ণনা এসেছে অন্যদিকে ফজর নামায ছাড়া সব ফরয নামায দুইয়ের বেশী।
ফরয নামাযান্তে হাত তুলে সম্মিলিত আকারে দুয়ার সমর্থনে উপরোক্ত দলীলগুলি ছাড়া আরো কিছু দলীল ও সাহাবার আসার দ্বারা দলীল দেওয়ার চেষ্টা করা হয় কিন্তু সবগুলির অবস্থা এমন যা হাদীসবিষারদদের নিকট অগ্রহণীয়।
৫–উপরোক্ত আলোচনার সারাংশঃ
উপরোক্ত দলীল-প্রমাণের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, ফরয নামাযে সালাম ফিরানোর পরের সময়টি যেমন যিকর-আযকার করার সময় তেমন এই সময় দুয়ারও সময় কিন্তু এই দুয়া একা-একা চুপি চুপি হবে এবং তাতে হাত তুলা প্রমাণিত নয় আর না সম্মিলিত ভাবে করা প্রমাণিত। তাই যে বা যারা এই সময় হাত তুলে ইমামের নেতৃত্বে সম্মিলিত ভাবে দুয়া করে তারা এই দুয়া করার নিয়ম-পদ্ধতি আবিষ্কারক, যা দ্বীনে নবাবিষ্কার। তাই তা বিদআহ ও প্রত্যাখ্যাত।
৬– সউদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড কি বলে?
সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদকে প্রশ্ন করা হয়, ফরয নামায বাদ দুয়া করা কি সুন্নত, এই দুয়া কি দুই হাত তুলে হবে…?
তাঁরা উত্তরে বলেনঃ ফরয নামায বাদ দুয়া সুন্নত নয়, যদি তা হাত তুলে হয়। চাই এটা একা ইমামের পক্ষ থেকে হোক, কিংবা একা মুস্বল্লীর পক্ষ থেকে হোক কিংবা উভয় কর্তৃক হোক; বরং এটা বিদআত। কারণ এমন করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত নয়, আর না তাঁর সাহাবা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। এ ছাড়া দুয়াতে সমস্যা নেই এ সম্পর্কে কতিপয় হাদীস উল্লেখ থাকার কারণে। [ফাতাওয়াল লাজনা আদ্ দায়িমাহ,৭/১০৩]
লেখক: আব্দুর রাকীব (মাদানী)
দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার, খাফজী, সউদী আরব
আরও পড়ুন:
- ইমাম ও ইমামতি (পর্ব-১)
- ইমাম ও ইমামতি (পর্ব-২)
- ইমাম ও ইমামতি-(পর্ব ৩)
- ইমাম ও ইমামতি (পর্ব-৪)
- ইমাম ও ইমামতি (৫ম পর্ব)