সৌদি আরব নিয়ে জনসাধারণের ধারণা একটু অদ্ভুত। কেউ ভাবেন এখানে লোকে হাইওয়েতে চলাচল করে উটের পিঠে চড়ে। কেউ ভাবেন এখানকার লোকগুলো সব বেদুইন। দেশ থেকে হজ্জ বা উমরা করতে এসে এখানকার দোকানপাট দেখে যখন সবার মাথা ঘুরে যায়, খুব অবাক লাগে আমার এদেশটাকে মনে হয় লোকে under developed বলে ধরেই এখানে আসে। একবার দাহরান এর King Fahad University তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একজন ভারতীয় হিন্দু প্রফেসর এলেন ট্রেনিং দিতে। ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস এর ঢুকে উনি বিশ্বাস এ করতে পারছিলেন না যে এটা সৌদি আরব। সম্ভবত তিনি আশা করছিলেন উন্নত বিল্ডিং এ না, তাঁবুতে থাকে সকলে। আবার একদল মানুষ আছেন যারা সৌদি আরব এর সচ্ছলতার কথা বড় বেশী ভালভাবে জানেন। তাঁরা এখানে আসেন সেই উদ্দেশ্য নিয়েই— দিনের পর দিন এখানকার সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে দেশে ফিরে আবার এদেশেরই বদনাম করেন। খুব কম মানুষই এই মরুভূমির দেশটির অসাধারণ সুন্দর দিকটি দেখতে পান অথবা দেখতে চান।
প্রথমবার এদেশে এসে যে শহরে চার বছর ছিলাম, সেখানে আমাদের উপমহাদেশের মানুষই বেশী। শহরের নাম দাহরান। সেখানে থাকা অবস্থায় আমি নিজেও আরব দের জীবনধারা, তাদের ধর্মীও দিকটি কেমন তা জানতাম না। তবে আমার মনে ওদের প্রতি কোন বিদ্বেষ ছিল না। কারন এদেশেই এমন মানুষের জন্ম যারা ইসলামের প্রচারের জন্য নিজের সবকিছু ত্যাগ করে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। আরবদের সাথে তেমন পরিচয় না হলেও বিভিন্ন সময় তাদের অযাচিত সাহায্য পেয়েছি। অবাক লাগত। অবাক লাগত যখন আমাদের গাড়ি নষ্ট দেখে কোন আরব নিজের গন্তব্যে না যেয়ে আমাদের জন্য মেকানিক ডেকে এনেছেন। অবাক লাগত যখন হজ্জের সময় রাস্তায় পরিশ্রান্ত হাজীদের ওরা পানি, জুস, খাবার দিয়ে যেত। আমি নিজেও কতবার নিয়েছি সেসব— যারা হজ্জ করেছেন, তাঁরা জেনে থাকবেন যে একেক সময় রাস্তায় যখন পিপাসা পায় বা খিদা লাগে আর সাথে কিছু থাকে না, কেমন অসহায় লাগে। সবচেয়ে মজার কথা হোল এসব খাবার কে দিচ্ছেন তাঁর নাম কিন্তু কেউ জানতেও পারে না। এখানে মানুষের সাথে কোন সম্পর্কই নেই— কোন ভোট চাওয়া না, কোন সভা করে খাবার বিলানো না—শুধু মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর মেহমানদের উপকার করা। সবার হয়ত অত সামর্থ্য নেই যে লোক খাওয়াবে। তিনি হয়ত তাঁর সন্তান কে রাস্তায়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন হাতে এক বাক্স টিস্যু দিয়ে। হেঁটে পার হওয়া ঘর্মাক্ত হাজীদের হাতে ছেলেটি সেই টিস্যু তুলে দিবে। আর হজ্জ কেন। রমজান মাসে দাহরান এ ইফতারের সময় সিগনালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন অনেকে—কারুর হাতে পানি, কারুর হাতে খেজুর— যার যতটুকু সামর্থ্য তাই নিয়ে। যখন রেড লাইটে গাড়ি থামে, তাঁরা মিনতি করতে থাকেন তাঁদের এই সামান্য উপহার নিয়ে তাঁদেরকে সম্মানিত করার জন্য। এই সামান্য উপহারের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে কী অসামান্য পুরস্কার পাবেন তাঁরা তা কল্পনা করতেও চোখ ভিজে ওঠে। মদীনার মাসজিদ উন নববীতে কোন বাবা তাঁর ছেলেকে নিয়ে আসেন ইফতারের সময়, খেজুর, পানি, চা , রুটি যা আনতে পারেন সব নিয়ে। কেউ জানেও না তাঁদের পরিচয়, আর না তাঁরা কারুর ধন্যবাদ শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। আর তাঁদের সন্তানগুলো বড় হয় মানুষের থেকে কিছু আশা না করে কিভাবে মানুষকে সাহায্য করতে হয় তার বাস্তব শিক্ষা পেয়ে। “We feed you seeking Allah’s Countenance only. We wish for no reward, nor thanks from you.” — সূরা ইনসানের এই আয়াতের জীবন্ত দৃষ্টান্ত এই মানুষগুলো। অনেকে আমাকে বলেছেন যে এসব করতে টাকা লাগে, ওদের আছে তাই ওরা করে। এক প্যাকেট টিস্যু কিনতে বড়লোক হওয়ার প্রয়োজন নেই কিন্তু। প্রয়োজন পরিষ্কার অন্তরের, আর কোন ভালো কাজকেই তুচ্ছ করে না দেখার মত বড় মনের। আর দোকানে রাস্তায় যারা ঝাড়ুদারের হাতে চুপি চুপি রিয়াল গুঁজে দেন, কখনো ১০, কখনো ১০০—এমন ভাবে যে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো মানুষটিও জানবে না এই দানের কথা—- তাঁদের কথা নাই বা বললাম। অনেক সময় ধরে খেয়াল করে দেখলে বুঝা যায় যে ঝাড়ুদারদের পাশ দিয়ে যারা যাচ্ছে ওরা চিপ্সের প্যাকেট বা টিস্যু ফেলতে অদিক দিয়ে যাচ্ছে না, যাচ্ছে ওদের হাতে টাকা তুলে দিতে।
এতো গেল এখানকার মানুষের এমন কিছু practice এর কথা যা অন্ধ না হলে যে কেউ দেখতে পাবে। এবার যখন বুরাইদা শহরে এলাম, আমার মনে হোল আমি নতুন কোন জগতে এসে পড়েছি। এখানে অনারব খুব কম। যারা আছেন তাঁরা যথারীতি আরবদের সাথে মেশেন না। আমার এদের সাথে পরিচয় হয়েছে জুম্মা পড়তে যেয়ে। আর আরবি ভাষায় মোটামুটি কথা চালিয়ে নিতে পারি বলে। তাছাড়া আমার মেয়েও পড়ে আরবি মাধ্যমে। বড় ভালো লাগে দেখতে ছোটবেলা থেকে ওরা কিভাবে বাচ্চাদের আকীদার শিক্ষা দেয়। আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে যখন এসে আমাকে প্রশ্ন করে “মান রব্বুনা?” (আমাদের রব কে?) — তখন বুঝি কেন এই দেশে প্রকাশ্যে শিরক এবং বিদাত চোখে পড়ে না। সাধারণ মানুষ বড় হয় অন্তরে আল্লাহর পরিচয় নিয়ে। এখানে যখন কেউ ভ্রান্ত পথে চলে, তখন সত্যিই তার অনেক ঝামেলা করে ভুল পথে চলতে হয়। মসজিদে মসজিদে আলিমরা ক্লাস নেন, যে কেউ এসে বসতে পারে, শুনতে পারে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ প্রায়ই আয়োজন করে দারস এর— খাবারের ব্যবস্থা ওরা করবে, অনেকসময় পুরস্কারের ব্যবস্থাও থাকে— শুধু সবাই যেন কষ্ট করে এসে শুনে যায়। মহিলারা একেকজন চার পাঁচ সন্তান নিয়ে এসে বসে শুনেন, শিখেন। মা হওয়াটা উন্নতির পথে বাঁধা— এই চরম ভুল ধারণা এঁরা ভেঙ্গে দেখিয়েছেন। নিজেরা কুরআন মুখস্থ করছেন, সন্তানদের শেখাচ্ছেন। আবার ঘরের যাবতীয় কাজও করছেন। আমার প্রতিবেশিকেই তো দেখি…ঘরের কাজও করেন আমার চেয়ে বেশী, ইসলামের পড়ালেখাও আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশী। ইসলাম এর সাথে সম্পর্কহীন জীবন যেমন এদের না, তেমনি জীবনের সাথে সম্পর্কহীন ইসলাম ও তাঁদের না। একদিন পার্কে দেখলাম এক বুড়ি কুরআন পড়ছেন আর তার মধ্যবয়স্ক ছেলে তা শুধরে দিচ্ছেন। হয়ত অল্প বয়সে সময় পাননি সংসার সামলানটাকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই আজকে হাফিয ছেলের কাছে বসে শিখে নিচ্ছেন। এখানে সাধারণ মানুষগুলোর জীবন ইসলাম কেন্দ্রিক। বাসা ভাড়া নেয়ার সময় contract এ লেখা থাকে যে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের মসজিদে সালাহ আদায় করতে হবে। কারন তাঁরা চান তাঁদের মহল্লার মানুষগুলো যেন ইসলামের ওপর থাকে। এক ঘরে আগুন জ্বলতে দিলে নিজের ঘরেও যে তার আঁচ এসে পড়বে এটা তাঁরা বোঝেন। এখানে এক বাঙ্গালী ভাই থাকেন তাঁর নিজের দোকানের পাশে— তাঁর প্রতিবেশী সকলেই সৌদি। সকালে প্রায়ই ঘুম ভেঙ্গে দরজা খুলে দেখেন গেটের সামনে বাক্স ভরতি ফল রাখা। কখনো উৎকৃষ্ট খেজুর, কখনো কমলা, ওদের বাগানের। তাঁরা তাঁদের লোকদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন যেন প্রতিবেশীকে সবসময় একটা অংশ দেয়া হয়। যখন যেটার উৎপাদন হয়, তখন সেটা এনে ওরা গেটের সামনে রেখে যায়। এই ভাই জানেন ও না কোন প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে কোনটা এলো। আমি বাংলাদেশী। কিন্তু যতবার ওদের কেউ এটা শুনেছে, একবারও অন্য চোখে তাকাতে দেখিনি। শিক্ষিত বা ধার্মিক মানুষগুলো কখনো কে কোন দেশের তা বিচার করতে বসেন না। তাঁরা শুধু দেখতে চান তাঁদের দেশে এসে যারা থাকছে, তারা যেন ইসলাম মেনে চলে।
বলতে চাইলে এদেশের খারাপ দিকগুলো ও তুলে ধরা যায়। কিন্তু আমার এই লেখার উদ্দেশ্য এখানকার ধর্মীয় মূল্যবোধের সামান্য একটু অংশ তুলে ধরা। মানুষ জানে না যে এদেশটা এখনো কিভাবে ইসলাম ধরে রেখেছে। সরকারের ভূমিকা, বা কিছু মানুষের অন্যায়ের কারনে, অথবা কম ধার্মিক কিছু মানুষের ভুল আচরনের দরুন এদেশের খারাপ দিকটাই সবাই জানেন। আসম্ভব ভালো মানুষগুলোর কথা তাই কারুর মনেই আসে না। যেমন বললাম, অনেকেই বলবেন এদেশের খারাপ দিকগুলোর কথা। পৃথিবীতে এমন কোনও দেশ নেই যেখানে সবাই ভালো। খারাপ মানুষ সব জায়গাতেই থাকে। যা কিছু এখানে খারাপ, তার চেয়েও শতগুণে খারাপ জিনিস যেসব দেশে আছে, সেখানেও দিনের পর দিন আমাদের অনেকেই থাকেন এবং থাকতে গর্ব বোধ করেন। কিন্তু দেশটি সৌদি আরব বলে, মক্কা মদীনার দেশ বলে, ইসলাম এর জন্ম এখানে বলেই হয়ত শয়তান আমাদেরকে এখানকার খারাপ দিকটি এতো বড় করে দেখায়। এতো বেশী আমরা এদেশের বদনাম করি যে এর মাঝে যে প্রচুর ভালো লুকিয়ে নেই, বরং প্রকাশ্যেই আছে—তা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। আমাদের দেখতে না পাওয়াটা কোনকিছুর অনুপস্থিতি প্রমান করে না। বরং দেখতে অস্বীকার করে আমরা যে শুধু এই জায়গাটার প্রতি অবিচার করি তাই না, এখান থেকে benefit নিতেও ব্যর্থ হই। দিনের পর দিন এখানে থেকেও অনেক মানুষেরই ধর্মীও কোন পরিবর্তন আসে না। মনেহয় তাঁরা বুঝি নিজেদের চারিদিকে প্রাচীর তুলে দিয়েছেন—- কিছু দেখবেন না, শুনবেন না, বুঝবেন না। সে যাই হোক, বলছিলাম খারাপ মানুষ আর ভালো মানুষের কথা। খারাপ মানুষ এদেশেও আছে যেমন থাকে আর অন্য সব দেশে। আমার বাবা ছিলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আল্লাহ আমাকে পৃথিবীর বহু দেশে যাওয়ার তৌফিক দিয়েছেন। আর বড় হয়েছি বাংলাদেশে। আমি কোন প্রকার দ্বিধা ছাড়া জোর গলায় বলতে পারি—- একসাথে এতো বেশী খাঁটি চরিত্রের মানুষ আমি আর কোথাও দেখিনি। আর সেই সাথে এও বলতে পারি, সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা এবং মূল্যবোধ আমরা যদি আমাদের সন্তানদের দেই একেবারে ছোটবেলা থেকে—একদিন ইনশাআল্লাহ আমাদের দেশেও এমন খাঁটি মানুষ ঘরে ঘরে দেখা যাবে।
by Nayla Nuzhat
(সংগৃহীত)
চলবে….ইনশাআল্লাহ
Shekh apnar kotha shune mone hocche,Saudi arobe shudhu bhalo lok e ache,kintu apni mone nirjatito bangali der dhekhen nai,oder omanobik nirjaton choke porle apnar shob proshongsha bani bondho hoye jeto,1000 manusher moddhe 1 jon bhalo hole take bhalo bola jay na.amar moto hazar o bangladeshi ache,jara oi manob rupi poshuder shikar,tai shudhu proshongsha na kore oder kharap dik tao ullekh korleo bhalo.