কিয়ামতের প্রথম প্রশ্ন ছলাত: আপনি কি প্রস্তুত?

কিয়ামতের প্রথম প্রশ্ন ছলাত: আপনি কি প্রস্তুত?

আজকের পোস্টে ছয়টি বিষয় আলোচিত হয়েছে:

১) ছলাতের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ।

২) ফযীলত বা মর্যাদা।

৩) ইসলামে নামাযের গুরুত্ব।

৪) নামাযের বিধান।

৫) অসময়ে নামায আদায়ের ভয়াবহতা।

৬) নামাযের কয়েকটি উপকারিতা।

১) ছলাতের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ:

ছলাত (الصلاة) শব্দের আভিধানিক অর্থ দুআ। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ছালাত হল, নির্দিষ্ট কিছু কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহ ইবাদত করা, যা তাকবীর তথাআল্লাহু আকবা বলে শুরু করতে হয় এবং তাসলীম তথা আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্বলে শেষ করতে হয়।

২) নামাযের ফযীলতঃ

আল্লাহ তাআলা বলেন:

(إنَّ الصَّلاَةَ تَنْهَى عَنْ الْفَحْشاَءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللهِ أكْبَرُ وَاللهُ يَعْلَمُ ماَ تَصْنَعُوْنَ)

নিশ্চয় নামায অশ্লিলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে, আর আল্লাহর  যিকির (স্মরণ) হল সবচাইতে বড়, এবং তোমরা যা কর সে স¤পর্কে তিনি জ্ঞান রাখেন।(সূরা আনকাবুত: ৪৫)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেনঃ

أرأيتُم لَوْ أنَّ نَهْراً بِباَبِ أحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ, هَلْ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ ؟ قاَلُوْا : لاَ يَبْقىَ مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ . قَالَ: فَذَلِكَ مِثْلُ الصَّلَواَتِ الْخَمْسِ, يَمْحُوْ اللهُ بِهِنَّ الْخَطاَياَ

তোমরা কি মনে কর, তোমাদের কারো ঘরের সামনে যদি একটি নদী প্রবাহিত থাকে। এবং প্রতিদিন সে উহাতে পাঁচ বার গোসল করে, তবে তার শরীরে কোন ময়লা থাকবে কি? তাঁরা (সাহাবাগণ) বললেনঃ তার শরীরে কোন ময়লাই বাকী থাকতে পারে না। তিনি বললেনঃ এরূপ উদাহরণ হল পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ক্ষেত্রেও। এভাবে নামাযের বিনিময়ে আল্লাহ্ নামাযীর যাবতীয় (ছোট) পাপ মোচন করে দেন।” (সহীহ বুখারী। অনুচ্ছেদ: পাঁচ ওয়াক্ত নামায গুনাহ সমূহের কাফফারা স্বরূপ)

৩) ইসলামে নামাযের মর্যাদাঃ

১) ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামায হল দ্বিতীয় স্তম্ভ। কালেমার পরেই উহার স্থান। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)কে উর্ধ্বাকাশে মেরাজে নিয়ে সরাসরি কথপোকথনের মাধ্যমে মুসলিম জাতির উপর এই নামায ফরয করেছেন।

২) বান্দা সর্বপ্রথম নামাযের ব্যাপারেই জিজ্ঞাসিত হবে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

( إنَّ أوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ بِصَلاَتِهِ , فَإنْ صَلَحَتْ فَقَدْ أفْلَحَ وَأنْجَحَ ,وَإنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خاَبَ وَخَسِرَ…)

“(কিয়ামতের ময়দানে)বান্দার সর্বপ্রথম যে আমলের হিসাব নেয়া হবে তা হল এই নামাযউহা যদি বিশুদ্ধ  হয়ে যায় তবে সে মুক্তি পেয়ে গেল ও সফল হল। আর উহা যদি বিনষ্ট বা বরবাদ হয়ে যায়, তবে সে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেল।(তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাঊদ ও ইবনু মাজাহ্। হাদীছের ভাষ্য নাসাঈর)

৪) নামাযের বিধানঃ

ইসলামে নামাযের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে কেহ যদি নামাযের অপরিহার্যতা অস্বীকার করে তবে এ সম্পর্কে তাকে জ্ঞান দান করা হবে। নসীহত গ্রহন করলে ভাল কথা। অন্যথায় সে কাফের হিসেবে গণ্য হবে। আর অবাধ্যতা বা হঠকারিতার কারণে যদি নামাযের অপরিহার্যতা অস্বীকার করে তবে নামায পড়লেও সে কাফের হিসেবে গণ্য হবে।

বুরাইদা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

(إنَّ الْعَهْدَ الَّذِيْ بَيْنَناَ وَبَيْنَهُمْ الصَّلاَةُ، فَمَنْ تَرَكَهاَ فَقَدْ كَفَرَ )    

তাদের (কাফেরদের) এবং আমাদের মাঝে চুক্তি হচ্ছে নামাযে, যে উহা পরিত্যাগ করল সে কুফুরী করল।(তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনু মাজাহ্)

হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ

( إنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكُ الصَّـلاَةِ )

নিশ্চয় একজন ব্যক্তি, র্শিক এবং কুফুরীর মাঝে (পর্দা বা) পার্থক্য হল নামায পরিত্যাগ করা।(মুসলিম)

 এ কারণে সন্তান সাত বছর বয়সে পদার্পণ করলেই তাকে নামাযের নির্দেশ দিতে হবে। যাতে করে সে এ ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

مُرُوْا أوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَهُمْ أبْنَاءُ سَبْعَ سِنِيْنَ, وَاضْرِبُوْهُمْ عَلَيْهاَ وَهُمْ أبْناَءُ عَشَرَ سِنِيْنَ, وَفَرِّقُوْا بَيْنَهُمْ فِيْ الْمَضاَجِعِ

সন্তানদের বয়স সাত বছর হলে তোমারা তাদেরকে নামাযের জন্য আদেশ করবে। দশ বছর বয়সে নামায না পড়লে তাদেরকে প্রহার করবে, এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দিবে। (আবু দাউদ)

৫) অসময়ে নামায আদায় করা ভয়াবহতা:

ইচ্ছাকৃত ভাবে অসময়ে নামায আদায় বৈধ নয় (হারাম)। তবে দুই নামায একত্রিত করার যে শরীয়ত সম্মত বিধান আছে সে অনুযায়ী অসময়ে নামায আদায় করা যায়।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

إنَّ الصَّلاَةَ كاَنَتْ عَلىَ الْمُؤْمِنِيْنَ كِتاَباً مَوْقُوْتاً

নিশ্চয় (নির্দিষ্ট) সময়ের মধ্যে নামায আদায় করা মমিনদের উপর ফরয করা হয়েছে।(সূরা নিসা: ১০৩)

দেখা যায় অনেকে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য সূর্য উঠার পর টাইম দিয়ে এলার্ম ঘড়ি প্রস্তুত করে এবং ফযরের সময় জামাতের নামায পরিত্যাগ করে। এরূপ করা কাবীরা গুনাহ্ অন্তর্গত; বরং কোন কোন ফিকাহবিদ এরূপ করা কুফুরী বলেছেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

(إنَّ الصَّلاَةَ تَنْهَي عَنْ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ ولَذِكْرُ اللهِ أكْبَرُ وَاللهُ يَعْلَمُ ماَ تَصْنَعُوْنَ)

নিশ্চয় নামায অশ্লীলতা (পাপাচার) ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে, আর আল্লাহ যিকির (স্মরণ) হল সবচাইতে বড়, এবং তোমরা যা কর সে স¤পর্কে তিনি জ্ঞান রাখেন।(সূরা আনকাবূত: ৪৫)

৬) নামাযের কয়েকটি উপকারিতাঃ

ক) নামায ব্যক্তিকে পাপাচার থেকে বিরত রাখে:নামায ব্যক্তিকে পাপাচার থেকে বিরত রাখে। যেমন,আল্লাহ্ বলেন,

(إنَّ الصَّلاَةَ تَنْهَي عَنْ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ)

নিশ্চয় নামায অশ্লিলতা (পাপাচার) ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।(সূরা আনকাবূত: ৪৫)

খ) বিপদ-মুসিবতে আত্মাকে শক্তিশালী করে:নামায বিপদ-মুসিবতে আত্মাকে শক্তিশালী করে। তাই আল্লাহ্ তায়ালা ধৈর্য ও ছলাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করার নিদের্শ দিয়ে বলেন,

(وَاسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ)

তোমরা ধৈর্য এবং নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।(সূরা বাকারা: ১৫৩)

গ) নামাযের মাধ্যমে অন্তরে নেমে আসে প্রগাঢ়শান্তি এবং এর মাধ্যমে প্রভুর সাথে নামাযীর প্রগাঢ় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়:নামাযের মাধ্যমে অন্তরে নেমে আসে প্রগাঢ় শান্তি এবং এর মাধ্যমে প্রভুর সাথে নামাযীর প্রগাঢ় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়নামায হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তির হৃদয়ের প্রশান্তি এবং তার সাহায্যকারী। যেমন রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলতেন, হে বেলাল! নামাযের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্তি দাও।(সুনান আবু দাউদ। শাইখ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)

ঘ) নামায মুসলিম সমাজে প্রেম-ভালাবাসা এবং সত্যিকার ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন সৃষ্টিকরে:নামায মুসলিম সমাজে প্রেম-ভালাবাসা এবং সত্যিকার ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন সৃষ্টিকরে। কেননা, দৈনন্দিন পাঁচবার শৃংখলার সাথে নামায আদায়ের লক্ষ্যে সমবেত হওয়া আত্মিক স¤পর্ক গড়ে তোলার জন্য শ্রেষ্ঠ পন্থা। পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধতার জন্য সুন্দর নিয়ম।

আর একক প্রভুর উদ্দেশ্যে একটি মাত্র ইবাদত আদায়ের লক্ষ্যে মুসলিম হৃদয় ধাবিত হওয়া, সমভাবে প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়া- তাদের আত্মীক পরিচ্ছন্নতা ও পারস্পাপরিক শ্রদ্ধাশীল সম্পর্কের দাবীদার।

ঙ) আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে নামাযের উপকারিতা সুপ্রমাণিত:আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রমাণিত হয়েছে যে, নামাযের মাধ্যমে শরীরের গ্রন্থি সমূহ এবং মাংশপেশীকে রোগমুক্ত রাখতে প্রভূত সাহায্য পাওয়া যায়।

পরিশেষেআসুন, আমরা নিজেরা নিজেরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথা সময়ে আদায় করি, নিজেদের স্ত্রী-পরিবার, সন্তান-সন্ততিকে নামাযের নিদের্শ প্রদান করি। বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশি, সহকর্মী সহ প্রতিটি মুসলিমকে নামাযে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য উৎসহিত করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

অনুবাদক: মুহা: আব্দুল্লাহ আল কাফী

সাবেক অনুবাদক ও দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব।

নামায সম্পর্কে আরও পড়ুন:

  1.  নামাযের ফযীলতে ২৫টি সুসংবাদ
  2. আমি কি ছালাত আদায় করি?
  3. আলবানী রাহ: প্রণিত ‘রাসূল সা. এর নামাযের পদ্ধতি’ সাথে একটি অনন্য নামায ভিডিও টেউটোরিয়াল
  4. রাত জাগার কারণে নামায দেরী করে আদায় করা
  5. জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *